
পাল্টাপাল্টি হামলায় পাকিস্তানে ৮০, ভারতে ১৫ জন নিহত
- আপলোড সময় : ০৮-০৫-২০২৫ ০৭:০৮:৩২ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৮-০৫-২০২৫ ০৭:০৮:৩২ অপরাহ্ন


* ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের জেলাগুলোতে পুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশ
* ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান, একটি যুদ্ধ ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত ও বেশ কয়েকটি চেকপোস্টসহ একাধিক ব্রিগেড সদর দফতর ধ্বংস করেছে পাকিস্তান
* পাকিস্তানের নোসেরি বাঁধেও হামলা চালিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী
জম্মু ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার জেরে তৈরি উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে গত বুধবার ভোররাতে পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি শহরে একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। ভারতীয় নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে, দেশটির তিন বাহিনী-স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী সমন্বিতভাবে এ অপারেশন চালিয়েছে। এতে ৮০ জন জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে তারা। তবে ভারতের সীমান্ত লাগোয়া ভারতের বিভিন্ন এলাকায় কামানের গোলা ছুড়েছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। ভারতের সেনাবাহিনী বলেছে, গত মঙ্গলবার রাত থেকে পাকিস্তানের ছোড়া কামানের গোলার আঘাতে ভারতে ১৫ বেসামরিক নাগরিক নিহত ও ৪৩ জন আহত হয়েছেন।
ভারতের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, এই অভিযানে জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদ, লস্কর-ই-তইয়্যেবা এবং হিজবুল মুজাহিদিন-এর অন্তত ৯টি ঘাঁটি ধ্বংস করা হয়েছে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার মতে, সবচেয়ে বড় দু’টি হামলা হয়েছে বাহাওয়ালপুর এবং মুরিদকেতে, যেখানে প্রায় ২৫-৩০ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে। সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের খবরে বলা হয়েছে, বিশেষ করে মুরিদকেতে অবস্থিত ‘মসজিদ ও মারকাজ তাইয়্যেবা’, যা লস্কর-ই-তইয়্যেবার আদর্শিক কেন্দ্র এবং দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের ‘সন্ত্রাসের নার্সারি’ হিসেবে পরিচিত, সেটিকে সফলভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। ভারত বলছে, হামলা চালানো এই ৯টি স্থানের মধ্যে ৪টি পাকিস্তানের ভেতরে এবং ৫টি আজাদ কাশ্মীরে অবস্থিত। ভারতের দাবি, এই অভিযানে পাকিস্তানি কোনো সেনাঘাঁটি লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি। ভারতীয় সূত্র দাবি করেছে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, আইএসআই এবং স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ (এসএসজি) সরাসরি এই জঙ্গি ঘাঁটিগুলোর সহায়তায় যুক্ত ছিল।
তবে উত্তেজনার মধ্যে গতকাল বুধবার ভোররাতে পাকিস্তানের একাধিক শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারতীয় সেনারা। এই অভিযানের নাম দেয়া হয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’। অন্যদিকে, ভারতীয় হামলাকে ‘বিনা প্ররোচনায় কাপুরুষোচিত’ বলে আখ্যা দিয়েছে পাকিস্তান। তারা পাল্টা জবাব দেয়া শুরু করেছে। জিও নিউজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাল্টা হামলায় ভারতীয় বিমানবাহিনীর (আইএএফ) পাঁচটি যুদ্ধবিমান, একটি ড্রোন এবং একটি ব্রিগেড সদর দফতর ধ্বংস করেছে পাকিস্তান। নিরাপত্তা সূত্রের খবর অনুসারে, বার্নালা সেক্টরে পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘনকারী একটি ভারতীয় ড্রোন পাকিস্তান সেনাবাহিনী গুলি করে ভূপাতিত করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত দেশের নাগরিকদের সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানাচ্ছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া উত্তর ভারতগামী ভ্রমণ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
ভারতের দাবি, পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের নয়টি ‘সন্ত্রাসী ক্যাম্প’ এ ২৪টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ৮০ জন সন্ত্রাসীকে হত্যা করা হয়েছে। আরও ৬০ জন আহত হয়েছে। তবে পাকিস্তানের দাবি, ভারতের আক্রমণের ফলে ২৬ জন নিরীহ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন এবং ৪৬ জন আহত হয়েছেন। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হামলার বেশিরভাগই মসজিদ লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। জিও নিউজের প্রতিবেদন মতে, পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরের পূর্ব আহমেদপুরে মসজিদে সুবহানাল্লাহতে ১৩ জন শহীদ হয়েছেন। এর মধ্যে দু’টি ৩ বছর বয়সি মেয়ে, সাতজন নারী ও চারজন পুরুষ। এতে ৩৭ জন আহত হয়েছেন। যাদের ৯ জন নারী ও ২৮ জন পুরুষ।
বিবিসির এক প্রতিবেদন মতে, মসজিদে সুবহানাল্লাহতে মাওলানা মাসুদ আজহারের পরিবারের ১০ সদস্য ও ৪ ঘনিষ্ঠ সহযোগী নিহত হয়েছে। পাকিস্তানভিত্তিক জয়শ-ই-মোহাম্মদের (জেইএম) পক্ষ থেকে গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে এ খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। মাওলানা মাসুদ আজহার সংগঠনটির প্রধান। জাতিসংঘের ‘সন্ত্রাসী’ তালিকায় মাসুদ আজহারের নাম রয়েছে। মুজাফফরাবাদে মসজিদে বিলালে ৩ জন শহীদ হয়েছেন। এছাড়া এক কিশোরী ও এক কিশোর আহত হয়েছেন। কোটলির মসজিদ আব্বাসে একটি ১৬ বছর বয়সি মেয়ে ও একটি ১৮ বছর বয়সি ছেলে নিহত হয়েছে। পাশাপাশি এক মা ও তার শিশুসন্তান আহত হয়েছেন। মুরিদকের মসজিদে উম্মুল কুরায় হামলায় ৩ জন নিহত ও একজন আহত হয়েছেন। শিয়ালকোটের হামলায় কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। শাকরগড়ের হামলায় একটি ডিসপেন্সারি/ফার্মেসি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ভারতের হামলায় পাকিস্তানের নীলম-ঝিলাম জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নোসেরি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। বিপরীতে পাকিস্তানের হামলায় ভারতে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছে বলে দেশটির গণমাধ্যমে জানানো হয়েছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বরাতে এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের প্রতিশোধমূলক গোলাবর্ষণে ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরে দুই শিশুসহ ১৫ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৪৮ জন আহত হয়েছেন।
গতকাল বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী জানান, ভারতীয় বিমানের সাথে সংঘর্ষে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সমস্ত যুদ্ধবিমান নিরাপদে রয়েছে। সেনাবাহিনীর শীর্ষ মুখপাত্র আরও জানান, ভারতীয় বিমান বাহিনীর ধ্বংস হওয়া যুদ্ধবিমানের মধ্যে তিনটিই ফ্রান্সের তৈরি রাফায়েল এবং রাশিয়ার তৈরি একটি এসইউ-৩০এমকেআই এবং একটি এমআইজি-২৯ ফুলক্রাম। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো নিশ্চিত করেছে, কমপক্ষে ৩টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভারতীয় ভূখণ্ডের ভেতরে ‘বিধ্বস্ত’ হয়েছে। অন্য কথায়, ভারত স্বীকার করেছে যে, গত মঙ্গলবার রাতে পাকিস্তান তাদের কমপক্ষে ৩টি বিমান ভূপাতিত করেছে। বাকি দু’টি এখনও নিশ্চিতকরণের অপেক্ষায় রয়েছে। পাকিস্তান আরও দাবি করেছে, তাদের সশস্ত্র বাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) বরাবর বেশ কয়েকটি সেক্টরে ভারতের একাধিক পোস্ট ধ্বংস করেছে। রাত থেকেই সীমান্তে তীব্র গুলি বিনিময় চলছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাদের সাথে লড়াই করছে।
পাকিস্তান-ভিত্তিক সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদের (জেইএম) এক বিবৃতি থেকে জানা গেছে, পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরের ‘সুবহান আল্লাহ’ মসজিদে ভারতের সামরিক বাহিনীর হামলায় মাওলানা মাসুদ আজহারের পরিবারের অন্তত ১০ সদস্য নিহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার মধ্যরাতের এই হামলায় তার আরও ৪ ঘনিষ্ঠ সহযোগীও নিহত হয়েছেন। পাকিস্তানি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন মাওলানা মাসুদ আজহার। তার এই সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে জাতিসংঘ।
জইশ-ই-মোহাম্মদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মাসুদ আজহারের বড় বোন, তার স্বামী, তার ভাগ্নে, তার স্ত্রী, ভাগ্নী এবং তার পরিবারের পাঁচ সন্তান রয়েছে। এছাড়াও ভারতের হামলায় সুবহান আল্লাহ মসজিদে মাসুদ আজহারের ঘনিষ্ঠ আরও তিন সহযোগী নিহত হয়েছেন বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। মাসুদ আজহার বলেছেন, স্বজনদের মৃত্যুতে তার কোনও আফসোস কিংবা হতাশা নেই। বরং বারবার আমার মনে হচ্ছে, আমিও এই ১৪ সদস্যের সুখী কাফেলায় যোগ দিতে পারতাম। তাদের চলে যাওয়ার সময় এসেছিল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তাদের হত্যা করেননি। বাহাওয়ালপুরে নিহতদের জানাজায় অংশ নেয়ার জন্য লোকজনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ২০০১ সালে ভারতের পার্লামেন্টে, ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে, ২০১৬ সালে পাঠানকোটে এবং ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার সঙ্গে মাসুদ আজহার জড়িত বলে অভিযোগ করে আসছে ভারত। ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরের পুলওয়ামায় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন্দুকধারীদের হামলায় ভারতের আধা-সামরিক বাহিনী সিআরপিএফের ৪০ জওয়ানের প্রাণহানি ঘটে। পুলওয়ামার এই হামলায় জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রধান মাওলানা মাসুদ আজহার ও তার ভাই আবদুর রউফ আসগর জড়িত বলে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে দাবি করা হয়। পুলওয়ামায় হামলার ঘটনার পরও চিরবৈরী এ দুই দেশের মাঝে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিল। যদিও পরবর্তীতে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং পাল্টা হামলার পর সেই উত্তেজনার অবসান ঘটে।
এদিকে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে নীলম নদীর ওপর নির্মিত নোসেরি বাঁধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে ভারত হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের নিরাপত্তা সূত্রের বরাতে গতকাল বুধবার এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন। সূত্রটি জানিয়েছে, স্থানীয় সময় রাত ২টার দিকে এই গোলাবর্ষণে বাঁধটির পানি গ্রহণকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য চেয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিএনএন। তবে এখন পর্যন্ত তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। নীলম নদী সিন্ধু নদী ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা পাকিস্তান ও উত্তর ভারতের কোটি মানুষের জীবিকা ও কৃষি নির্ভরতার অন্যতম ভিত্তি।
অপরদিকে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর পুলিশ সুপারদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে বাংলাদেশ পুলিশ বার্ষিক শ্যুটিং প্রতিযোগিতা ২০২৪-এর সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি এ তথ্য জানান। আইজিপি বলেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা যেন বিঘ্নিত না হয়, কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী যেন আমাদের দেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সীমান্ত জেলাগুলোর পুলিশ সুপারদের সতর্ক করা হয়েছে। এ সময় বাংলাদেশ পুলিশ ক্লাবের সভাপতি ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত আইজিপি মো. মোস্তফা কামালসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ